কিনওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা - Quinoa Health Benefits

 কিনওয়ার  স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তা 


কিনওয়া কি ? ( What is Quinoa?)

আমরা যতরকম শস্যদানা খায় তার মধ্যে থেকে সব থেকে পুষ্টিকর হল কিনওয়া। কিনওয়ার উৎপত্তি সাউথ আমেরিকার পেরু থেকে। তারপর আস্তে আস্তে এর পরিচিতি বাড়ে এবং কানাডা , ইটালি , ভারত , U.S এবং Sweden -এও এর উৎপাদন শুরু হয়। তবে ভারতে এর প্রচলন ঘরে ঘরে নেই।অনেকেই হয়ত কিনওয়ার নাম শোনেন নি, কিন্তু এটি খুব স্বাস্থ্যকর এবং বেশ প্রচলিত একটি দানাশস্য। কিনোয়াকে দানাশস্য না বলে এক প্রকারের বীজও বলা যায় যা উচ্চ প্রোটিন যুক্ত। তাই আজকাল ভারতেও এর প্রচলন বেড়েছে।  সব থেকে বড় কথা হল এটি আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে তাই ডায়েটে থাকা ছেলে - মেয়ের মধ্যে এর প্রচলন বেশ বেড়েছে। 
বাঙালিরা হয়ত কিনওয়ার নাম তেমন শোনেননি কিন্তু যদি আমি বলি কাওন চাল তাহলে হয়ত কেউ কেউ চিনতে পারেন।  আমার মায়ের কাছে শুনেছি যে আগে ঠাকুমা উপোস করলে কাওনের চালের খিচুড়ি খেতো। এই কিনওয়া নাকি কাওনেরই মতো।  
শুধু ওজন কমানো নয়, কিনওয়ার আরো অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে। সেই সব কিছু আমরা একে একে জানবো। 



কিনওয়ার পুষ্টি সম্পর্কিত তথ্য ( Nutrition facts of Quinoa) 

১ কাপ রান্না করা কিনওয়ার পুষ্টি মূল্য (১৮৫ গ্রাম ) - 

  • ২২২ ক্যালোরি 
  • প্রোটিন - ৮.১৪ গ্রাম 
  • ফাইবার - ৫.১৮ গ্রাম 
  • ফ্যাট - ৩.৫৫গ্রাম 
  • কার্বোহাইড্রেট - ৩৯.৪ গ্রাম 
  • ম্যাঙ্গানিজ -  RDA (Recommended Daily Allowance ) - এর ৫৮ % 
  • কপার - RDA - এর ১৮% 
  • আয়রন - RDA -এর ১৫% 
  • ম্যাগনেসিয়াম - RDA -এর ৩০% 
  • ফসফরাস - RDA -এর ২৮% 
  • জিঙ্ক - RDA - ১৩% 
  • পটাসিয়াম - RDA -এর ৯% 
  • ফোলেট - RDA - এর ১৯% 
  • ভিটামিন বি ১, বি ২, বি ৬ - RDA - এর ১০% এর বেশি 
এছাড়া থাকে ক্যালসিয়াম , ভিটামিটন বি ৩ , ভিটামিন E এবং ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। 


কিনওয়ার উপকারিতা ( Health Benefits of Quinoa )

কিনওয়া গ্লুটেন-ফ্রি ( Gluten -free ) এবং উচ্চ প্রোটিন যুক্ত দানাশস্য, যাতে আছে ৯ টি প্রধান অ্যামিনো অ্যাসিড।  এছাড়াও এতে আছে উচ্চমাত্রায় ফাইবার, ভিটামিন, আইরন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং আন্টি অক্সিডেন্ট।  
 

ওটস যেমন একটি শস্যদানা যা আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে সেরকমই কিনওয়াও এমন এক শস্যদানা যা আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে। প্রতি ১০০ গ্রামে  কিনওয়া এবং ওটসে  একই মাত্রায়  প্রোটিন থাকে।  ওটসের তুলনায় কিনওয়া অবশ্য কম ফ্যাট যুক্ত কিন্তু আবার ওটসে ফাইবারের পরিমাণ কিনওয়ার থেকে বেশি থাকে।  কিনওয়াতে ৯ টি অ্যামিনো অ্যাসিড থাকায় এবং উচ্চ প্রোটিন যুক্ত হওয়ায় যারা খেলাধুলার সাথে যুক্ত তাদের ডায়েট-এও কিনওয়া রাখতে বলা হয়।  তাই জন্য স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ ওটসের সাথে সাথে কিনওয়াও নিজের খাদ্য তালিকায় রাখেন। শুধু  ক্রীড়াবিদ নয় যেকোনো মানুষই কিনওয়াকে নিজের খাদ্য তালিকায় যুক্ত করতে পারেন।  কারণ এর মধ্যে প্রচুর গুণাবলী আছে যা আমাদের শরীরকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। আগে কিনওয়ার এত প্রচলন না থাকলেও এখন কিনওয়ার বেশ প্রচল দেখতে পাওয়া যায়।  কোনো ফিটনেস এবং হেল্থ স্টোরে , বা কোনো রেস্টুরেন্টের মেনুতে যেখানে স্যালাড বা স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়া যায়।   


 

এবার আমরা জেনে নি কিনওয়ার কি কি স্বাস্থ্যকর গুন্ আছে - 

১. ওজন কমাতে সাহায্য করে - 

কিনওয়া উচ্চ ফাইবার যুক্ত এবং উচ্চ প্রোটিন যুক্ত দানাশস্য যা আমাদের দেহের ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।  ফাইবার আর প্রোটিন আমাদের পেট অনেকক্ষন ভরিয়ে রাখতে সাহায্য তাই এটি ওয়েট কমানোর জন্য উপযুক্ত খাবার। এর মধ্যে ফ্যাটের পরিমাণও অনেক কম থাকে।  কিনওয়াতে গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের পরিমাণ কম থাকে , এটি আমাদের দেহের এনার্জিকে সহজে  হ্রাস হতে দেয় না এবং ক্ষুধা শক্তিকে অনেকাংশে কম করে।  সেইজন্য এটি ডায়েট ফুড হিসেবে একদম উপযুক্ত। 

২. দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে - 

কিনওয়াতে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস বেশি থাকে যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে এবং দীর্ঘস্থায়ী রজার ঝুঁকিও কমিয়ে দেয়।  কিনওয়াতে অল্প পরিমাণ ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে এবং অন্যান্য শস্যদানা বা সিরিয়ালস ( Cereals)-এর থেকে মনোস্যাটুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণও বেশি থাকে তাই অন্যান্য সব শস্যদানার তুলনায় এটি বেশি স্বাস্থ্যকর।  

৩. ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে - 

ডায়াবেটিস রোগী এখন ঘরে ঘরে , শুধু বংশপরম্পরায় নয় আজকাল অনেক কারণেই কম বয়সেই অনেক ছেলে মেয়ে ডায়াবেটিসের শিকার হচ্ছে।  কিনওয়া ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাবার ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপযুক্ত আর  কিনওয়া হল  উচ্চ ফাইবার যুক্ত তাই এটি শরীরে শর্করার পরিমাণ কম রাখতে সাহায্য করে।  গ্লাইসেমিক ইনডেক্স  বেশি থাকা খাবার  আমাদের ক্ষুধা বাড়াতে এবং ওজন বৃদ্ধিতে  সাহায্য করে। তেমনি গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকা খাবার যেমন কিনওয়া,  বিভিন্ন রোগ যেমন হার্টের সমস্যা এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস কমাতেও সাহায্য করে। কিনওয়ায়  গ্লাইসেমিক ইনডেক্স- এর পরিমাণ ৫৩, যা কম বলে ধরা হয়।  কিন্তু সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে এতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ অনেক বেশি।  

৪. কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে - 

কিনওয়ার ১ কাপ এ ৫গ্রাম ফাইবার থাকে যা আমাদের শরীরের ডাইজেশানে সাহায্য করে এবং কোলেস্টেরলের লেভেল কমাতে সাহায্য করে।  ২০১০ এর নেদারল্যান্ডের এক গবেষণা অনুযায়ী , ইঁদুরদের উপর এক পরীক্ষা করা হয়।  তাতে প্রথমে তাদের উচ্চ ফ্রুক্টোস যুক্ত ডায়েট দেওয়া হয় যাতে তাদের শরীরে লিডল (LDL)- এর মাত্রা বেড়ে যায় , এরপরে তাদের কিনওয়ার ডায়েট দেওয়া হয় যাতে তাদের শরীরের লিডলের (LDL) মাত্রা ৫৭% কমে যায়।  কিনওয়া আমাদের শরীরের জমে থাকে বাজে কোলেস্টেরল কে কম করতে সাহায্য করে।  তাই আপনার কোলেস্টেরলের সমস্যা থাকে অবশ্যই ডায়েটে কিনওয়া যুক্ত করুন।  

৫. হার্টের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে - 

হার্টের সমস্যা দূর করতেও কিনওয়ার জবার নেই।  শরীরে যখন একটা রজার দানা বাধে তখন আস্তে আস্তে অন্য রোগেও ও জন্ম হয় , যেমন ধরুন যদি LDL কোলেস্টেরলের মাত্রা আপনার দেহে সঠিক থাকে তাহলে হার্টের সমস্যাও কম হয়।  কিনওয়া হল এমন একটি খাবার যা আমাদের শরীরে ২টো জিনিস ই নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।  জার্নাল অফ ফুড লিপিডে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে কিনওয়াতে অনেকগুলি ডায়াটারি ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে যা হার্টের সমস্যায় কার্যকর।  

৬. শরীরের হাড় মজবুত রাখতে এবং বৃদ্ধিতে সাহায্য করে - 

কিনওয়ার মধ্যে ৯ টি অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে যা আমাদের পেশী গঠনে সাহায্য করে , এবং আমাদের হাড় মজবুত রাখে।  এতে থাকে উচ্চ প্রোটিন এবং ক্যালসিয়াম যা আমাদের হাড়ের মধ্যে ক্যালসিয়ামের শোষণ এবং কোলাজেনের বিকাশের পাশাপাশি হাড়ের ম্যাট্রিক্সের স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। 


৭. উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তলপতা  কমাতে সাহায্য করে - 

কিনওয়া কোলেস্টেরল কমানোর সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপ কমাতেও সাহায্য করে।  কিনওয়াকে সুপারফুড বা সুপারগ্রেইন বলা হয় যা বিভিন্ন রোগ নির্মূলে সাহায্য করে।  গবেষণায় দেখা গেছে যে কিনওয়াতে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টি অক্সিডেন্ট quercetin থাকে , যা আমাদের শরীরের পক্ষে ভালো।  উচ্চ ফাইবার আমাদের রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার সমস্যা দূর করে।  

৮. ত্বকের সুরক্ষায় সাহায্য করে - 

কিনওয়াতে থাকে  বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন যা আমাদের ত্বকের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। আমাদের শরীরে বয়সের ভাঁজ কমিয়ে ত্বককে উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে।  এতে থাকা ভিটামিন বি ১২ এবং বি ৬ ত্বকের রং ধরে রাখতে এবং ত্বককে মসৃণ রাখে।  এমনকি ত্বকের বার্ধক্য জনিত সমস্যাও দূর করে।  

৯. সম্প্রতি গবেষণায় দেখা যায় যে কিনওয়াতে ভিটামিন -বি পরিবারের সদস্য রিবোফ্লাভিন বেশি মাত্রায় থাকে যা কোষে অক্সিজেন পরিবহণের উন্নতি করে মাইগ্রেনের ব্যথা দূর করে।   

১০. কিনওয়াতে বেশি পরিমাণে ফাইবার থাকায় তা আমাদের ডাইজেশনেও সাহায্য করে , অনেকক্ষন আমাদের পেটও ভর্তি রাখে যার ফলে খিদেও কম পায়।  কিনওয়া খুব তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায়।  

১১. কিনওয়া গ্লুটেন -ফ্রি (Gluten -free) খাবার। যাদের গ্লুটেন সহ্য হয়না বা এলার্জি আছে  তাদের জন্য একদম উপযুক্ত।  


সব কিছুর যেমন ভালো দিক থাকে তেমনি খারাপ দিকও থাকে। কিনওয়ার থেকেও কিছু অসুবিধা বা শারীরিক সমস্যা হতে পারে।  পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার মতে কিনওয়ার বীজের উপর একটা লেয়ারের মতন  থাকে Saponins - স্যাপোনিনস নামের একপ্রকার ক্যামিক্যাল যা গাছগুলোকে ছত্রাক বা ভাইরাস জনিত রোগ থেকে দূরে রাখে।  স্যাপোনিনস বিস্বাদ এবং তেতো স্বাদযুক্ত হয় যা শরীরের পড়লে ক্ষতিকর।  তাই রান্না করার আগে কিনওয়াকে খুব ভালো করে বার বার জলে ধুতে হয় যাতে ওই তেতোভাবটা কমে যায়।  

 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ